রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার এক যুগপার, স্বাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে বিচার প্রক্রিয়া

এখনো ফিরে আসেনি সেই আলোচিত উত্তম বড়ুয়া

by The Justice Bangla

মোহাম্মদ খোরশেদ হেলালী কক্সবাজার উত্তর প্রতিনিধিঃ কক্সবাজারের রামু, উখিয়া এবং টেকনাফে বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নি-সংযোগের ১৩ বছর পার হতে চলেছে। এসব ঘটনায় পৃথক দেড় ডজন মামলা হলেও সাক্ষীর অভাবে একযুগেও এগোয়নি বিচার কার্যক্রম। মামলাগুলো বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকায় অভিযুক্তদের অনেকে জামিনে এসে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কেউ কেউ চলে গেছেন বিদেশেও।

এই পরিস্থিতিতে আলোচিত রামু ট্র্যাজেডি বিচারপ্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা। তাদের ভাষ্য, রাজনৈতিক কারণে মামলার মূল বিষয় উঠে আসেনি এবং বিচার প্রক্রিয়া ধীর গতি হয়েছে। এ ঘটনায় দায়ের মামলাগুলো পুন:তদন্ত করে জড়িতদের শনাক্ত এবং দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন তারা।

কক্সবাজার জেলা জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ফোরামের সদস্য সচিব মিথুন বড়ুয়া বোথাম বলেন, ১৩ বছরে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিহার পাওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেতুবন্ধন ফের মজবুত হয়েছে। কিন্তু হৃদয়ে গোপন রক্তক্ষরণ এখনও থামেনি। মামলাগুলো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় ঘটনার মূল কারণ উদঘাটন হয়নি। দায়ী অনেকে বাদ পড়েছেন। আমরা এখনও শংকামুক্ত নয়। বিচারহীনতায় দোষীরা শাস্তির বদলে বুক ফুলিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে, প্রত্যাশা ২০১২সালের সেই ঘটনা যেন আর কোনোদিন না ঘটে। হামলায় জড়িতদের ছবি-ভিডিও দেখে এসব মামলাগুলো পুন:তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।

রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিপুল বড়ুয়া জানান, ২০১২ সালের এ হামলায় জড়িতরা কোনো ধর্মের হতে পারে না। মামলার বিচার না হওয়ায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মনের দাগ এখনও মুছেনি। বিগত সরকার এ ঘটনার বিচার শেষ করতে পারেনি। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও বছর পার করেছে- কিন্তু কোনো আশার আলো দেখছি না। মূল অপরাধীদের শনাক্ত করে পুনঃতদন্ত পূর্বক দ্রুত বিচারের দাবি জানাচ্ছি।

রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের আবাসিক প্রধান ও কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, সাক্ষীর অভাবে বিচার কার্যক্রম ধীরগতিতে ছিল। মামলাগুলো সর্বশেষ কোন পরিস্থিতিতে আছে আমাদের কাছে তথ্য নেই। দুর্বৃত্তদের নারকীয় সেই হামলা সারা বিশ্বকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। দোষীদের শাস্তি না হলে তারা আবারও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে পারে। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত একটা মামলারও বিচার হয়নি, এটি বড় হতাশাজনক।

এদিকে, মামলাগুলোর চলমান প্রক্রিয়ার বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন বলে জানিয়েছেন জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি আইনজীবী (পিপি) সিরাজুল ইসলাম। মুঠোফোনে তিনি বলেন, বৌদ্ধপল্লী ট্র্যাজেডি ১৮টি মামলা বিভিন্ন আদালতে ভাগ হয়ে চলছে। কোন মামলার কি অবস্থা স্ব-স্ব আদালতের আইন কর্মকর্তা ও কোর্ট ইন্সপেক্টর জানতে পারেন।

জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাবেক পিপি আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান ও ফরিদুল আলমও জানিয়েছিলেন সাক্ষীর অভাবে বিচার প্রক্রিয়া এগুচ্ছে না। এখনও একই অবস্থা বিরাজমান বলে জানিয়েছেন জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও নাজির বেদারুল আলম।

সূত্রমতে, বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত স্পর্শকাতর ও আলোচিত ১৮টি মামলায় প্রায় ৯০০ জন আসামি ও ১৬০ জন সাক্ষী আছেন। মামলাগুলো বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। কিন্তু সাক্ষীদের অনুপস্থিতি বিচার প্রক্রিয়া একপ্রকার থমকে আছে। সাক্ষীদের নামে সমন জারি হলেও সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন সাক্ষীরা। তিনটির মতো মামলা পুন:তদন্তের জন্য পিবিআই-এর কাছে রয়েছে।

রামুর বাসিন্দা সাজু বড়ুয়া বলেন, বৌদ্ধ পল্লী ট্র্যাজেডি ঘটনায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনের পরিবর্তে মামলার বাদী হয়েছে পুলিশ, তদন্তও করেছে পুলিশ। এতে ইচ্ছে মতো আসামি করে অভিযোগপত্র থেকে বাদও দেওয়া হয়েছে। ন্যক্কারজনক এ ঘটনা কেন ঘটেছিল, নেপথ্য কারণ একযুগেও উন্মোচিত হয়নি। সেদিন হামলায় চেনা-অচেনা অনেকেই অংশ নিয়েছিল। বিভিন্ন স্থিরচিত্র, ভিডিও ফুটেজ এবং তদন্ত প্রতিবেদনেও তার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু প্রকৃত আসামিদের অনেকেই আড়াল হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, হামলার পর এলাকায় সকল সম্প্রদায়ের মাঝে ফের ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির বন্ধন পুরোনো সময়ের মতো হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে পুড়ে যাওয়া বিহারগুলো। তাই, নতুন করে সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার ভয়ে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অনিহা প্রকাশ করছেন।

রামু উপজেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি রিটন বড়ুয়া বলেন, হামলার ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে তাদের অনেকেই চার্জশিট থেকে বাদ গেছে। আবার হামলায় জড়িত নেই এমন অনেকে আসামি হয়েছেন। তাই সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। সাক্ষীরা পরিবার নিয়ে বাস করেন, তাদের নিরাপত্তাহীনতার চিন্তাও রয়েছে।

এদিকে ২৯ সেপ্টেম্বর দিনটিকে ঘিরে ‘বুড্ডিস্ট স্যোশাল মুভমেন্ট’ সংগঠনের আয়োজনে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়। সকাল ৬টায় বুদ্ধ উপাসনা ও পতাকা উত্তোলন, অষ্টশীল গ্রহণ, চিত্রাঙ্কন ও চিত্র, চলচিত্র ও প্রামাণিক চিত্র প্রদর্শনী। অন্যান্য বছর র‌্যালি অনুষ্ঠিত হলেও এ বছর র‌্যালী বের হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।

স্থানীয়দের তথ্য মতে, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে উত্তম বড়ুয়া নামে এক যুবক পবিত্র কোরআন অবমাননা করেছে এমন গুজবের জেরে রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধবিহার এবং বৌদ্ধপল্লীর ২৬টি ঘরে অগ্নি-সংযোগ, লুটপাট ও হামলা চালানো হয়। এ ঘটনার জেরে পরদিন উখিয়া-টেকনাফের আরও সাতটি বৌদ্ধবিহার পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়। মামলায় ৩৭৫ জনের নাম উল্লেখসহ আসামি করা হয় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে। পরে একটি মামলা প্রত্যাহার হলেও ১৮ মামলায় ৯৯৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে চার্জ গঠনের পর সাক্ষীরা আদালতে এসে সাক্ষী দিতে অনিহা প্রকাশ করেন।

এ ঘটনার পর থেকে আজও খোঁজ মেলেনি উত্তম বড়ুয়া নামের ওই যুবকের। উত্তমের বাবা সুদত্ত বড়ুয়া ও মা মাধু বড়ুয়া জানেন না, ঘটনার পর থেকে উত্তম কোথায় আছেন। অপেক্ষায় আছেন ছেলে একদিন ফিরে আসবেন।

কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা ও কক্সবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল বলেন, রামুর ধর্মীয় সম্প্রীতি শত বছরের। দীর্ঘ বছরের ঐতিহ্য ২০১২ সালের বিভীষিকাময় সেই রাতে নিমিষেই শেষ হয়। একযুগ পার হলেও ঘটনায় জড়িতরা বিচারের মুখোমুখি হয়নি। ভিডিও-ছবি দেখে নিরপরাধদের বাদ দিয়ে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। তবে, রামুতে পুরোনো সম্প্রীতির বন্ধন আবারও দৃঢ় হয়েছে- এটা আমাদের আশাবাদী করছে।

You may also like

Leave a Comment